প্রকৃতির আলো রহস্য


আব্দুল হান্নান আকিব

ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
         আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ ।
তুমি নও তো র্সূয, নও তো চন্দ্র, তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন র্পূণ করে আপন আলো জ্বলেছে॥
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 



জোনাকি পোকার আলো দেখে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। রাতের আকাশে তাদের  আলো দেখলে মনে হবে পৃথিবীতে আকাশের তারা নেমে এসেছে।জোনাকি পোকার আলো দানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ‘Bioluminescence’  বা ‘জৈব দীপ্তি’ শব্দটির। ‘জৈব দীপ্তি’ বলতে জীবন্ত জীব দ্বারা আলো উৎপাদন এবং নির্গমনকে বুঝায় এটি আবার কেমিলুমিসেন্স (Chemiluminescence)  বা ‘রাসায়নিক দীপ্তি’ এর একটি ধরণ।কেননা, এক্ষেত্রে  রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আলোক শক্তি উৎপন্ন হয়।

এরকম আলো দানকারী জীবের বিস্তৃতি কতটুকু তা আমাদের জানা প্রয়োজন।অনেকে ভেবে বসতে পারি শুধু বুঝি জোনাকি পোকাই এ আলো তৈরির বাহাদুরি করতে পারে।কিন্তু না উদ্ভিত ও স্তন্যপায়ী প্রাণী ছাড়া মোটামোটি বাকি সব শ্রেণির মধ্যেই এরকম জীব রয়েছে।তবে এরা বেশির ভাগই সামুদ্রিক মাছ (Anglerfish , Cookiecutter shark, Catshark, Flashlight fish, Gulper eel, Lanternfish, Marine hatchetfish, Midshipman fish, Pineconefish, Viperfish, Black dragonfish) ও অমেরুদন্ডী(Seapens, coral, jellyfish, Ostracods, Copepods, Krill, Certain cephalopods, Certain Octopuses, Bolitaenidae, Vampire squid, Sepiolida, Teuthida (squid), Colossal Squid, Mastigoteuthidae, Firefly squid যাদের মিঠা পানিতে পাওয়া যায় না।একই কাজ করতে সক্ষম কছিু টেরিস্টারিয়াল প্রাণী হচ্ছে ভরৎবভষরবং,পষরপশ নববঃষব,মষড়ি ড়িৎসং,ৎধরষৎড়ধফ ড়িৎসং। এমনকি এ তালিকায় আছে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের নামও।সম্প্রতি গওঞ এর বিজ্ঞানীরা এমন গাছ তৈরি করেছেন যা আলো বিকিরণ করতে পারে

এখন জানা যাক এ আলো তৈরির রাসায়নিক ব্যাখ্যা। এই আলো তৈরির উপাদান “লুসিফেরিন”(এক প্রকার আলো নিঃসরক রঞ্জক)।এর পাশাপাশি “লুসিফারেজ” (Luciferase) এনজাইম অথবা “ফটোপ্রোটিন” (photoprotein) এ দু’টির যেকোনো একটি লাগবেই।জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বিজ্ঞানী, জীববিদ্যার উইলিয়াম ম্যাকেলরয় আর রাসায়নের এমিল হোয়াইট দুজনে মিলে জোনাকির আলো (bioluminescence) নিয়ে অনেক কাজ করেছেন বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। ম্যাকেলরয় তো লোকজন পাঠাতেন জোনাকি ধরে আনার জন্য।উনি লুসিফারেজের ওপর অনেক কাজ করেছেন। আর এমিল হোয়াইট প্রথম লুসিফেরিনের গঠন আবিষ্কার করেন এবং তাঁর রাসায়নাগারে সেই অণুটিও তৈরি করেন।
লুসিফারেজের গঠন

জোনাকির (Firefly) ক্ষেত্রে জোনাকি লুসিফেরিন (Firefly luciferin), লুসিফারেজ এনজাইমের সাহায্যে ATP (aedenosine triphosphate)  এবং অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ডিঅক্সিটন (dioxetane) গোত্রের যৌগ তৈরি করে। তারপর স্বতঃস্ফূর্তভাবে COতৈরি করে আর তার সঙ্গে তৈরি করে অক্সিলুসিফেরিন (oxyluciferin)। এই অক্সিলুসিফেরিন উত্তেজিত অবস্থায় নীলাভ-সবুজ আলো বিকিরণ করে।

জেলিফিশের (Aequorea victoria )  ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীরা লুসিফারেজের বদলে একোয়ারিন (aequorin) নামক ফটোপ্রোটিন ব্যবহার করে। একোয়ারিন, আর একটি প্রোটিন সিলেন্ট্রাজিন, ক্যালসিয়াম আয়ন (Ca++ )  এবং অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে সিলেন্ট্রামাইড। বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন সিলেন্ট্রামাইড থেকে নীল রঙের আলো বেরোয়। এই আলো অনেক সময় ? GFP (গ্রীন ফলুরোসেন্ট প্রোটিন) শুষে নেয় আর ফল স্বরূপ সবুজ আলোর ফলুরোসেন্স দেখা যায়


লুসিফেরিন তাপ প্রতিরোধী হওয়ায় আলোকে ঠান্ডা রাখে ফলে এসব জীবের আলোয় তাপ নির্গত হয় না এবং তারা তাদের সমস্ত শক্তির শতভাগই আলোক শক্তিতে পরিণত করতে পারে।অপরদিকে, একটি বিদ্যুত বাতি তার শক্তির মাত্র দশ ভাগ আলোক শক্তিতে পরিণত করতে পারে,বাকি নব্বই ভাগই তাপে পরিণত হয়।

এই আলো দিয়ে জীবগুলো কী সুবিধা পায়? এই আলো জীবগুলো শিকার খোঁজা, শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য ক্যামোফেøজ তৈরি, একই প্রজাতির অন্য প্রাণীকে আকৃষ্ট করা, বহিরাগতকে সর্তক করা, ছদ্মবেশ (mimicry) ধারণ সহ আরো কিছু কাজে ব্যবহার করে

শিকারির হাত থেকে বাঁচার ব্যাপারটা না বললে নয়। অন্ধকার রুমে হঠাৎ করে কারো চোখে লাইট মারলে সে যেরকম চমকিয়ে উঠবে, তেমনি শিকার করতে আসা প্রাণীও বায়োলুমিনিসেন্ট প্রাণীর আলোর ঝলকে চমক খেয়ে ফিরে যাবে। শিকার ধরা বা শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন সামুদ্রিক স্কুইডের রং বদলানোও একধরণের বায়োলুমিনিসেন্স।যা ক্যামোফেøজ হিসেবে পরিচিত।এছাড়া স্কুইড এবং অক্টোপাসরা যে কালি সদৃশ বস্তু নিঃসরণ করে তা মূলত বিভিন্ন বায়োলুমিনিসেন্ট রাসায়নিকের মিশ্রণ।

জোনাকিরা আলো জ্বালে তাদের সঙ্গীদের আকৃষ্ট করা জন্য। আর ব্রাজিলের “ক্লিক বিটল” জাতীয় প্রাণীরা উজ্জ্বল সবুজাভ আলো জ্বালে তাদের খাদ্য বিভিন্ন উড়ন্ত পোকাদের আকর্ষণ করার জন্য। বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক ব্যাকটেরিয়া (যেমন: Vibrio fischeri, Vibrio harveyi  ) আলো বিকিরণ করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা, নিজের সসহযোগী বা শত্রুদের চেনার জন্যে। ব্যাকটেরিয়ার এ প্রক্রিয়াকে “কোরাম সেন্সিং” বলে।

বায়োলুমিনিসেন্স যে শুধু উক্ত জীবদের সহায়তা করছে তা নয় বরং বিজ্ঞানীরা এটিকে মানব কল্যাণে কাজে লাগাতে শুরু করেছেন। লুসিফারেজ সিস্টেমসমূহ জেনেটিক ইঞ্জেনিয়ারিং-এ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। গবেষণামূলক ক্যান্সার চিকিৎসায় BLADe(Bioluminescence activated destruction)।উইসকন  বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বায়োলুমিনিসেন্ট E.coli  ব্যাকটেরিয়া কৌলিগত পরিবর্তন করে বাল্ব হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছেন। পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করার জন্য যে Ò Microtox Ó  ব্যবহার করা হয় তাতে মূলত Vibrio fischeri ব্যাকটেরিয়ার কোরাম সেন্সিং-কে কাজে লাগানো হয়। যখন পানিতে কোনো বিষাক্ততা থাকে তখন এটির আলোর তীব্রতা কমে যায়।অনেক বায়োলুমিনিসেন্ট ছত্রাক গাছে লেগে থেকে আলো তৈরি করে।তাই পরিবেশবীদরা এই ধরণের ছত্রাক যুক্ত গাছ রাস্তার পাশে ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে Glowee নামক একটি ফরাসি প্রতিষ্ঠান বায়োলুমিনিসেন্ট বাতি বিক্রি শুরু করেছে।এক্ষেত্রে তারা Allivibrio fischeri  ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করেছে


কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে,পৃথিবী থেকে জোনাকির মতো আলোদানকারী জীবের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।এর প্রধান কারণ আলো দূষণ।রাতের বেলা ঝলমলে আলোর কারণে নিশাচর প্রাণী সহ নানা রকম পোকা ও প্রাণীর অসুবিধা হয়। তাই আমাদের উচিত আলো দূষণ কমিয়ে ফেলা।


No comments:

Powered by Blogger.