A tale of a CMCian

 



গল্পের শুরুটা কোথায় তা আমার অজানা। তবে ছোটবেলা থেকেই কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলে "বড় হয়ে তুমি কি হবে?" আমি এক কথায় বলে দিতাম "ডাক্তার হবো"।


স্কুল জীবনের শুরু ২০০৬ সালে নর্থ সিটি মডেল স্কুলে। তার আগে একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করাতে‌ চেয়েছিল কিন্তু বয়সের কারণে তারা আমাকে ভর্তি নেয় নি।

নর্থ সিটি ছিল আমার জীবনের স্বর্ণময় অধ্যায়। বলতে গেলে এখান থেকেই আমার বেসিক পড়ালেখার ভিত্তি গড়ে ওঠে। স্কুলের প্রত্যেক স্যার আমাকে নিজের সন্তানের মতো করে গড়ে তুলেন। বিশেষ করে 'হাবিবুল্লাহ বাহার স্যার' আমাদেরকে ক্লাস ফোর এবং ফাইভে আলাদা করে যেভাবে পড়িয়েছেন তার ফল সারা জীবনই ভোগ করি। ২০১২ সালে আমি প্রথম বোর্ড পরীক্ষা PECE দেই এবং এতে A+ সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে পুরো সীতাকুন্ড থানায় ৫ম স্থান অধিকার করি।

আমার লেখালেখির হাতে খড়ি থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত আমি আমার বড় ভাবী 'রাশেদা বেগম' এর কাছে পড়ি। ভাবিও আমাকে খুব যত্নসহকারে বুঝিয়ে পড়াতেন যা আমাকে পরবর্তীতে অনেক সাহায্য করেছে।


স্কুলের স্যাররা চেয়েছিল ক্লাস সিক্সে শহরের ভালো একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। কিন্তু যাতায়াতে সমস্যার জন্য আমার পরিবার আগ্রহ দেখায়নি, তারা আমাকে বাড়ির পাশে ফৌজদারহাট কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করান।

নতুন স্কুলের প্রথম প্রথম ভয় লাগছিল। কারন বন্ধু, পরিবেশ, স্যার সবই নতুন এবং পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে না বলেও মন খারাপ ছিল। তাছাড়া ভালো একটা সরকারি স্কুলে ভর্তি করেনি বলেও অনেকের কথা শুনতে হয়েছে। 

যাই হোক, স্কুল জীবনকে মানিয়ে নিলাম। স্যাররাও খুব আদর যত্ন করে কাছে টেনে নিলেন, সকল স্যারই ছিলেন খুবই আন্তরিক। বিশেষ করে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক 'শয়ন স্যার'কে সবাই ভয় পেলেও তিনি আমার প্রতি আলাদা স্নেহশীল ছিলেন, স্যারের পড়ানোর ধরন ছিল আলাদা।

ক্লাস সিক্সের শেষদিকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেয়ার জন্য শহরে একটা কোচিং এ ভর্তি হয়। তখন যাতায়াতের সমস্যা ছিল, তারপরও কোচিং চালিয়ে যায়। জানুয়ারিতে ভর্তি পরীক্ষা হয় কিন্তু আমি ক্যাডেটের জন্য সিলেক্ট হয়নি। 

সময় পেরিয়ে যায়, ২০১৫ তে দ্বিতীয় বোর্ড পরীক্ষা JSC দি। এইবারও A+ সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে সীতাকুণ্ড থানায় ১০ম স্থান অধিকার করি। 

তবে এইবার সরকারি স্কুলের জন্য আবেদন করি। ফলাফল দিতে দেরি হওয়ায় আগের স্কুলেই ক্লাস শুরু করি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারি স্কুলের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। আমি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের জন্য সিলেক্ট হয়। রেজাল্ট পাওয়ার পর অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম।


আবারো নতুন স্কুলে নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয়। এবার মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হয়। কারণ সবাই স্কুলে ক্লাসের চেয়ে ব্যক্তিগত পড়ায় বেশি আগ্রহী ছিল। কলেজিয়েটে থাকা অবস্থায় আমার অলিম্পিয়াডের জীবনের শুরু হয়। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ইংরেজি, বাংলা, অ্যাস্ট্রোনমি সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেও শুধুমাত্র বায়োলজি অলিম্পিয়াড অর্জনের পাল্লাটা ছিল ভারী। ২০১৭ সালে আঞ্চলিক পর্যায়ে 2nd Runner Up, ২০১৮ সালে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে 1st Runner Up এবং ২০২০ আঞ্চলিক পর্যায়ে Champion হয়। বায়োলজি অলিম্পিয়াড অংশগ্রহণের ফলে বায়োলজির প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়।

তবে বায়োলজি এর প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেন আমার প্রাইভেট টিউটর 'জাহেদ ভাই'। উনি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। উনার কাছে ক্লাস সিক্স থেকে SSC জানতো পড়ি। গণিত ও বিজ্ঞানের বিষয় গুলো বিশেষ করে জীব বিজ্ঞানের বিষয় গুলো আমাকে বাস্তবিক ভাবে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন এবং এখনো কোনো সমস্যায় পড়লে উনি আমাকে দূর থেকে সাহায্য করেন।


২০১৮ তে SSC পাস করি। এবার ইংরেজিতে A+ না পাওয়ায় অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়। তার সাথে নটরডেম কলেজে না টিকা এবং কম নাম্বার পেয়ে সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য ও কম কথা শুনতে হয়নি।

তাদের নেতিবাচক কথাগুলো আমার মাঝে জেদের রূপান্তরিত হয় এবং আমি বদ্ধপরিকর হয় যে "আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ভালো কিছু করতে হবে।"


সিটি কলেজে ক্লাস শুরু করি। কলেজ সম্পর্কে বাইরের মানুষের ধারণা যেমনটা ছিল কিন্তু ভিতরে তার ঠিক উল্টো। স্যাররা ছিলেন যথেষ্ট আন্তরিক। তাদের ক্লাসের পাশাপাশি মোটিভেশনাল কথা গুলো আমাকে খুবই সাহায্য করেছে। বিশেষ করে গোলাম খাজা স্যার, মান্নান স্যার, তানভীর স্যার এবং নুর নাহার ম্যাম। মান্নান স্যার বলতেন,"কোন একটা কাজ করবে ভাবছো, রাস্তায় নেমে পড়ো দেখবে ঠিক পৌঁছে যাবে।" নুরনাহার মেম বলতেন, "আমরা সব কিছু প্যারালালি করার চেষ্টা করি তাই আমরা সফল হয় না। কিন্তু যদি কোন একটা কাজ মন দিয়ে করার চেষ্টা কর তখন অবশ্যই সফল হবে।" উত্তম স্যার বলতেন, "life is a marathon race" 

কলেজে ক্লাসের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়তাম। জাহিদ স্যার আর মান্নান স্যারের কাছে সকালে পড়ে তারপর কলেজে ক্লাস করতাম। কলেজে ক্লাস শেষ হলে বিকালবেলা সিরাজ স্যার আর রিজভী ভাই এর কাছে ক্লাস করতাম। দুপুরে খাওয়ার জন্য আক্তার আপুর বাসায় চলে যেতাম। অন্যদিন উত্তম স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তাম। বাংলা বাসায় পড়তাম, আইসিটি আমার বড় ভাইয়া আর আপু বুঝাই দিতেন। কলেজে টিটোরিয়াল, পরীক্ষা, প্রেক্টিকেলে দিন কেটে যেতে লাগলো।


রিজভী ভাইয়ের সাথে পরিচয় ক্লাস নাইন থেকে। আমার বন্ধুরা চকবাজারে কোচিং করতো, ওদের কাছ থেকে রিজভী ভাই এর গল্প, কবিতা, ছন্দে পড়ানোর স্টাইল এর কথা শুনতাম এবং নোটগুলো দেখেও ভাল লাগত কিন্তু উনাকে সরাসরি তখনো দেখা হয়নি।

উনার সাথে প্রথম দেখা হয় ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে,‌গুলজার টাওয়ারের ছয় তলায় ক্লাস নিতেন। ক্লাসগগুলো খুবই ভালো লাগতো। আমি ফার্স্ট ইয়ার এবং সেকেন্ড ইয়ার পুরোটাই ওনার কাছে পড়ি। এডমিশন কোচিংও উনার কাছে করার সিদ্ধান্ত নি।

রিজভী ভাইয়া ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে তারপর ভর্তি নেন। HSC পরীক্ষার ২ মাস আগেই ভর্তি চালু করেন। 

হঠাৎ করোনা মহামারীর কারণে আমাদের বোর্ড পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তাই পরীক্ষা হওয়ার আগেই তিনি অনলাইনে ক্লাস শুরু করেন । প্রথমে এডমিশন এর পাশাপাশি এইচএসসি এর জন্য প্রস্তুতিমূলক সিডিউল করেন। পরে এইচএসসিতে পাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি পুরোদমে এডমিশনের ক্লাস চালু করেন। বিভিন্ন বই এবং প্রশ্নগুলোর কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিতেন। Chapter wise exam, Review exam, Paper final, Subject final, Viva, True False, Voice exam নানা ধরনের পরীক্ষা নেন। MCQ পরীক্ষাগুলো তার নিজস্ব Apps এ নিতেন। এছাড়াও গত বছর যারা উনার কাছ থেকে পরে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে তাদের সাথে আলোচনা করার সুযোগ করে দেন। 

আমার মনে হয় এডমিশন প্রিপারেশন এ যতগুলো এক্সাম দিয়েছি পুরো জীবনেও অতোগুলো এক্সাম দেইনি।

করোনা মহামারীর কারণে রুটিনে বারবার পরিবর্তন আসে।

 এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য তিনি আমাদেরকে সবসময় মোটিভেশন দিয়ে যেতেন। 


ভর্তি প্রস্তুতির মাঝে আরেকটা ডিফিকাল্ট সময় পার করি যখন আম্মুর শারীরিক অসুস্থতার কারণে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। বাসা থেকে হসপিটালে আসা-যাওয়া করে ক্লাস করতে হতো। বড় ভাইয়া থাকার কারণে তখন তেমন প্রেশার যায় নাই কিন্তু আমার এক্সামের এক মাস আগেই ভাইয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন আমাকে হসপিটালে থাকতে হয়। হসপিটালের দিনগুলো আমাকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলে এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি আরো দৃঢ় প্রত্যয়ী করে।


প্রথমে মার্চ মাসে পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও পরে এপ্রিল মাসের ২ তারিখ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। 

পরীক্ষার কদিন আগে কিছু Model Test ভাইয়া অফলাইনে নেন এবং শেষে একটা পরীক্ষার স্ট্রাটেজি নিয়ে ক্লাস নেন। 

অবশেষে চলে এলো স্বপ্নের সেই পরীক্ষা। এক ঘন্টার পরীক্ষা, জীবন পরিবর্তনের পরীক্ষা। পরীক্ষার সময় আমি কোন ধরনের নার্ভাসনেস ফীল করি নি। কিন্তু পরীক্ষা দেয়ার পর আমার টেনশন হঠাৎ বেড়ে যায়। সবাই উত্তরপত্র মিলাতে থাকলেও আমি সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন আমাকে কোনো না কোনো মেডিকেলে টিকিয়ে দেন।

রেজাল্ট দেয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার টেনশন ছিল। কিন্তু যখনই পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে পাই আমার মধ্যে কেমন একটা পরিবর্তন বোধ করলাম যা বলে বোঝানো মুশকিল। আশেপাশের সবাই অভিনন্দন জানাতে লাগলো।

আসলে আল্লাহর সাহায্য এবং পিতামাতা , শিক্ষক ও বড়দের দোয়া ছাড়া মেডিকেলে টিকা প্রায় অসম্ভব।

আজ আমি এতটুকু আসার জন্য পরিবারের সকল সদস্য বিশেষ করে আব্বু-আম্মু, সকল শিক্ষকবৃন্দ, শুভাকাঙ্খী ও বন্ধু বান্ধবদের প্রতি আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।


আব্দুল হান্নান আকিব

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

এক্স-সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম

No comments:

Powered by Blogger.